কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছর ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমদ কায়কাউসসহ বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
এই সিন্ডিকেট বিশেষ আইনের আওতায় এবং বিনা দরপত্রে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ দেয়। কেন্দ্রগুলো বছরে মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ ক্ষমতায় পরিচালিত হলেও, মালিকরা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করে। এই টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর একটি বড় অংশ তৎকালীন সরকারের নীতিনির্ধারক এবং সুবিধাভোগীদের পকেটে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিদ্যুৎ না পেলে কোনো পেমেন্ট হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে বিদ্যুৎ না নিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আসছে। তারা দাবি করেন, এ ধরনের অনিয়মের কারণে বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল অর্থ দেশের নাগরিকদের টাকা এবং তা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কোনো দরপত্র ছাড়াই প্রভাবশালী কোম্পানির কাছে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, কনফিডেন্স গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, ইউনিক গ্রুপ, বারাকা পাওয়ারসহ অন্যান্য কোম্পানি। এসব কোম্পানি সুবিধাভোগী হওয়ার কারণে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির আকার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, শেখ হাসিনা ও নসরুল হামিদ এ মন্ত্রণালয়ে টানা কয়েকটি মেয়াদ ধরে দায়িত্বে ছিলেন, কারণ এখানে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ হয়। তাদের ওপর অভিযোগ রয়েছে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা তারা বিদেশে পাচার করেছেন। এর পাশাপাশি সামিট গ্রুপের আজিজ খানসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সুবিধা নিয়ে বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বারবার বাড়ানো হয়েছে এবং ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। সরকার সুদসহ মূলধনি ব্যয় শোধ করলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং মেয়াদ বাড়ানোর পর একই কেন্দ্রের জন্য পুনরায় নির্মাণ ব্যয়ের টাকা দেওয়া হয়।
এদিকে, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, বিদ্যুৎ খাত থেকে অর্জিত বিপুল অর্থ তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও বিলাসবহুল সম্পদ কেনার অভিযোগ উঠেছে।
বিদ্যুৎ খাতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অপকর্মের নেতৃত্বে ছিলেন নসরুল হামিদ এবং তাকে সহায়তা করেন বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একাধিক রেন্টাল প্রকল্প বিনা টেন্ডারে অনুমোদন দেওয়া হয়, যা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা আয় করার সুযোগ করে দেয়।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সবচেয়ে বেশি অর্থ পেয়েছে সামিট গ্রুপ। বিদ্যুৎ খাতের আইনি সুবিধা নিয়ে এ গ্রুপ বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছে। সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ের বিদ্যুৎ ব্যবসার সুযোগ নিয়ে দেশের প্রথম শত হাজার কোটি টাকার মালিক হন এবং সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন।