কথাবার্তা দিয়ে একজন মানুষের ভালো-মন্দ সহজেই যাচাই করা যায়। এতে ফুটে ওঠে তার ব্যক্তিত্ব ও স্বভাব। কথাবার্তা মানুষকে যেমন জান্নাতে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে, তেমনই জাহান্নামের পথেও নিয়ে যেতে পারে। একজন মুমিনের কথাবার্তা কেমন হওয়া উচিত, কীভাবে সম্বোধন করা উচিত—এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে রাসুল (সা.)-এর জীবনে। নিচে মহানবী (সা.)-এর কথাবার্তা ও বাকভঙ্গির কিছু দিক তুলে ধরা হলো:
সত্যবাদিতা: সত্যবাদিতা হলো কথার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থাকা। সত্যের একটি প্রভাব আছে, যা মানুষকে আকর্ষণ করে। কোরআনে সত্য কথার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা তাওবা, আয়াত ১১৯)
রাসুল (সা.) নবুওয়াতের আগেও এবং পরে সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। শৈশব থেকেই তিনি সত্যবাদী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি সাহাবিদেরও সত্য বলার জন্য উৎসাহিত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই সত্য ভালো কাজের পথ দেখায়, আর ভালো কাজ জান্নাতের পথে নিয়ে যায়। আর মানুষ যখন সত্য কথা বলতে অভ্যস্ত হয়, তখন আল্লাহ তাকে সত্যবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন। অপরদিকে, মিথ্যা পাপের পথে নিয়ে যায়, আর পাপ জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। কেউ যখন মিথ্যা বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন আল্লাহ তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে লিপিবদ্ধ করেন।” (বুখারি, হাদিস ৬০৯৩)
স্পষ্টতা: কথাবার্তার অন্যতম গুণ হলো স্পষ্টতা। স্পষ্ট কথার প্রভাব শ্রোতার মনে গভীরভাবে পড়ে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.)-এর কথা এতটাই সুস্পষ্ট ছিল যে, প্রত্যেক শ্রোতা তা সহজেই বুঝতে পারত।’ (আবু দাউদ, হাদিস ৪৮৩৯)
ধীরস্থিরতা: ধীরস্থিরতা কথার একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ। দ্রুতগতিতে কথা বলা, যা শ্রোতার জন্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে, তা পরিত্যাজ্য। রাসুল (সা.) কথাবার্তায় ধীরস্থিরতা বজায় রাখতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল (সা.) এমনভাবে কথা বলতেন যে, যদি কেউ তার কথা গুনতে চাইত, তবে তা গুনতে পারত।’ (মুসলিম, হাদিস ৭৩৯৯)
মিষ্টভাষী: রাসুল (সা.) সবসময় কথাবার্তায় ও আচার-আচরণে কোমলতা অবলম্বন করতেন। তিনি কখনো কর্কশ বা রূঢ় ভাষায় কথা বলতেন না এবং কাউকে সেভাবে সম্বোধনও করতেন না। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি যদি কঠোর হৃদয়ের হতেন, তবে মানুষ আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যেত।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১৫৯)
বাহুল্য বর্জন: রাসুল (সা.) কখনো প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতেন না। তিনি সওয়াবহীন কাজে কখনো সময় ব্যয় করতেন না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির ইসলাম পালনের সৌন্দর্য হলো অনর্থক কথা ও কাজ পরিত্যাগ করা।’ (তিরমিজি, হাদিস ২৩১৮)
শালীনতা: রাসুল (সা.)-এর কথাবার্তা সর্বদা শালীনতার মধ্যে আবৃত থাকত। তিনি কখনো অশালীন কথা বলতেন না। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) কখনো অশালীন, অভিশাপকারী বা গালিদাতা ছিলেন না। তিনি কাউকে তিরস্কার করার সময় কেবল এটুকুই বলতেন—“তার কপাল ধূলিমলিন হোক।”’ (বুখারি, হাদিস ৬০৬৪)
বিশুদ্ধভাষী: রাসুল (সা.) ছিলেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী। তাঁর উচ্চারণ, শব্দ প্রয়োগ ও বাচনভঙ্গি সবই ছিল বিশুদ্ধতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। হিন্দ ইবনে আবু হালা (রা.) রাসুল (সা.)-এর বাচনভঙ্গি সম্পর্কে বলেন, ‘রাসুল (সা.) অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন। বিনা প্রয়োজনে কথা বলতেন না। তাঁর কথা স্পষ্ট ও অর্থবহ ছিল। তাঁর বাক্যগুলো ছিল আলাদা আলাদা, এবং অতিরিক্ত দীর্ঘ বা সংক্ষিপ্ত ছিল না। তাঁর কথার মর্মার্থ অনুধাবন করতে কোনো অসুবিধা হতো না। কথাবার্তায় কোনো কঠোরতা বা তাচ্ছিল্যের ভাব ছিল না।’ (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস ১৬৭)